বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:হেমতাবাদের বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনায় রায়ের রহস্যমৃত্যুতে তপ্ত পশ্চিমবাংলার রাজনীতি। সোমবার সকালে উত্তর দিনাজপুরের বালিয়া দেবেন মোড়ের কাছে বাজারের একটি দোকানের সামনে থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কিন্তু দেহ উদ্ধারের পরই জেলার পুলিশ সুপারের একটি মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের মনে হচ্ছে, এটি একটি আত্মহত্যার ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে, তদন্ত করার আগেই একজন বিধায়কের মৃত্যুকে কী করে পুলিশের তরফে আত্মহত্যার ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়? তবে বিধায়কের পরিবার ও তাঁর দল বিজেপির তরফে ঘটনাটিকে খুন বলে দাবি করা হয়েছে। এই ঘটনা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হলে রাজ্যের তরফে ঘটনার সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিজেপির দাবি, সিবিআই তদন্তের।
বিধায়কের স্ত্রী চাঁদিমা রায়ের অভিযোগ, খুন করা হয়েছে বিধায়ককে। স্থানীয়দেরও অনেকেই এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, বিধায়কের বাড়ি থেকে যে বাজারে দোকানের সামনে তাঁর দেহ পাওয়া গিয়েছে, সেটি অনেক দূরে। তার অনেক আগে বেশ কিছু নির্জন জায়গা রয়েছে। সেইসব জায়গা ছেড়ে বিধায়ক কেন অতদূরে আত্মহত্যা করতে যাবেন? তা ছাড়া গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত থাকলেও বিধায়কের একটি হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় উপরের দিকে ছিল। আত্মহত্যার ঘটনা হলে হাত বাঁধা থাকবে কেন? পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, সেইজন্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নেওয়া হচ্ছে। পরে পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, দেবেন্দ্রনাথ রায়ের জামার পকেট থেকে একটি সুসাইড নোট পাওয়া গিয়েছে। সেখানে দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাঁর মৃত্যুর জন্য তাঁদের দায়ী করা হয়েছে। বিজেপি অবশ্য পুলিশের সমস্ত দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। বিধায়ককে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে।
এদিন সকালেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ জানিয়ে দেন, এই ঘটনার শেষ দেখে তিনি ছাড়বেন। বলেন, ‘এর আগে পুরুলিয়ায় আমাদের কর্মীদের খুন করে জঙ্গলে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালিয়েছে। এবার বিধায়ককেও খুন করে একই কাজ করেছে।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আত্মহত্যা যদি করতেই হয়, তা হলে কেন বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে গিয়ে একটি দোকানের বারান্দা তিনি বেছে নেবেন?’ এলাকার এক যুব তৃণমূল নেতার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তিনি। দিলীপ ঘোষের মন্তব্যকে সমর্থন করেছে মৃত বিধায়কের পরিবার। ‘আত্মহত্যার তত্ত্ব’ মানতে নারাজ সিপিএম এবং কংগ্রেসও। তারাও এই মৃত্যু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম দাবি করেছেন, এই মৃত্যুর উপযুক্ত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেছেন, ‘বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যুর ঘটনা হত্যাকাণ্ড হলে বলব, এটা ভয়ঙ্কর ঘটনা।’
শুধু বিজেপির রাজ্য সভাপতিই নন, সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা টুইট করে লেখেন, ‘হেমতাবাদের বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের সম্ভাব্য জঘন্য হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নিন্দনীয়। পশ্চিমবাংলায় আইন–শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। এখানে গুণ্ডারাজ চলছে।’ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষও টুইট করে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে বিঁধেছেন। বিধায়কের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থেকে বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্যও। বিধায়কের মৃত্যুর ঘটনাকে খুন উল্লেখ করে রাজ্য বিজেপি সিবিআই তদন্তের দাবি করেছে। কিন্তু বিজেপির এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল এবং রাজ্য সরকার। তবে ঘটনাটিকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় সিআইডি–র হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে।
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশি নয় বিজেপি। তাই কলকাতা থেকে শুরু করে জেলায় জেলায় সারাদিন ধরেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। এখানেই থেমে থাকেনি তারা, আরও বড় ধরনের আন্দোলন শুরু করার কথাও জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ বন্ধের ডাক দিয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি ও অন্য নেতাদের পাল্টা সমালোচনা করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার প্রধান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম। তিনি কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়! মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। এটাই ওদের সংস্কৃতি।’ পাল্টা সমালোচনা করেছে বিজেপিও। বলেছে, বাম আমলে মৃতদেহ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলই রাজনীতি করত। এই বিতর্ক কোথায় গিয়ে থামে, সেটাই এখন দেখার।